দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিভিত্তিক (আইসিটি) বিভিন্ন উদ্ভাবনী ব্যবসার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। গত পাঁচ বছরে নতুন নতুন অনেক ডিজিটাল স্টার্টআপ তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক মূলধন পেলেও পরবর্তী ধাপে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় বড় বিনিয়োগের ঘাটতিতে রয়েছে এসব ডিজিটাল স্টার্টআপের অনেকেই।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউএসএআইডির পর্যবেক্ষণও বলছে, ডিজিটাল স্টার্টআপে বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বাড়লেও এখনো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশে ৪৫ হাজারের মতো সফটওয়্যার ডেভেলপার রয়েছে, যা অত্যন্ত সীমিত। এক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াতে গুরুত্ব দিতে হবে। স্টার্টআপ থেকে প্রতিষ্ঠিত ও তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়ার পথে যে ধাপগুলো রয়েছে, সেখানে অর্থায়নের সুযোগও কম। প্রাথমিক মূলধন পাওয়া গেলেও পরবর্তী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের শূন্যতা রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হয়েছে এমন ডিজিটাল স্টার্টআপগুলোর মধ্যে রয়েছে নিউজক্রিড, বিকাশ, অগমেডিক্স, বিডিজবস, সহজ ও পাঠাও। তিন বাংলাদেশী তরুণের গড়া স্টার্টআপ নিউজক্রিড তাদের গ্রাহকদের কনটেন্ট সরবরাহ করছে। এর বাইরে কনটেন্ট সম্পর্কিত একাধিক প্লাটফর্ম রয়েছে নিউজক্রিডের। এখন পর্যন্ত ৯ কোটি ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে ডিজিটাল স্টার্টআপ হিসেবে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি।
প্রাথমিকভাবে গেটস ফাউন্ডেশন, আইএফসি ও ব্র্যাকের বিনিয়োগ পেলেও পরবর্তী সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশে ৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে চীনের আলিবাবার প্রতিষ্ঠান অ্যান্টফিন্যান্সিয়াল। স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রতিষ্ঠান অগমেডিক্সে বিনিয়োগ হয়েছে ৪ কোটি ডলার। সিক ডটকম ডটএইউর কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে বিডিজবস ডটকম। ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্সের বিনিয়োগের পর সিঙ্গাপুরের গোল্ডেন গেট ক্যাপিটাল, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইভ হান্ড্রেড স্টার্টআপস ও লিনিয়ার ভিসির কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান সহজ। আরেক রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও ইন্দোনেশিয়ার গো-জেকের কাছ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে।
নিজেদের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে উদ্যোক্তাদের শুরুর চ্যালেঞ্জ হলো প্রাথমিক মূলধন জোগাড়। এরপর প্রতিষ্ঠান একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেলে সেটির সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজন হয় পরবর্তী বিনিয়োগ। বর্তমানে প্রাথমিক মূলধনের চেয়ে এটিকেই বড় বাধা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিনিয়োগ না পেলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সীমিত, কর্মী ছাঁটাই করতে হয় স্টার্টআপগুলোর। আর এ পর্যায়ে টিকে থাকতে না পারলে বন্ধও করে দিতে হয় প্রতিষ্ঠান। দেশেও বিভিন্ন স্টার্টআপ উদ্যোগের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে। সম্প্রতি দেশীয় রাইড শেয়ারিং স্টার্টআপ পাঠাও একসঙ্গে বেশকিছু কর্মী ছাঁটাই করে। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যয় রোধে এ কর্মী ছাঁটাই করা হয় বলে এক বিবৃতিতে দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া বিনিয়োগ না পেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে আরো বেশকিছু সম্ভাবনাময় স্টার্টআপ।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি এবং জব পোর্টাল বিডিজবস ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম ফাহিম মাশরুর বণিক বার্তাকে বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় এ খাতে এখনো অনেক পিছিয়ে আমরা। খাতটিতে বিনিয়োগের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে কম। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক ও ডিজিটাল ভিডিও সলিউশন প্রদানকারী দেশীয় স্টার্টআপ বঙ্গবিডি। রেজরের কাছ থেকে এটি বিনিয়োগ পেয়েছে ১০ লাখ ডলার। কিকশা ও সিন্দবাদের মতো ই-কমার্স প্লাটফর্ম ও মার্কেটপ্লেসের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান জিরো গ্র্যাভিটিতে ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্স ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে।
ডক্টরোলায় ৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে দেশীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান বিডিভেঞ্চার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), আইডিএলসি ও ৫০০ স্টার্টআপ যৌথভাবে ৯০ লাখ ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে চালডাল ডটকমে। আজকেরডিলে ২০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে ইনোটেক।
ডিরেক্ট ফ্রেশে ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে রেজর ও ব্র্যাক। ইপিলিয়ন গ্রুপ সেবাএক্সওয়াইজেডে ২০ লাখ ডলার, ভারতের আভিস্কার ক্লাউডওয়েলে ২০ লাখ ডলার, হংকংয়ের ওসিরিস শিওরক্যাশে ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। ব্রেইন স্টেশন২৩-তে আড়াই লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে যুক্তরাজ্যের আইপিই, ওরাকল ও বাংলাদেশের বিডিভেঞ্চার। অ্যাকসেঞ্চার জিপিআইটির ৫১ শতাংশ শেয়ার কিনে নিতে ১ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ভিসিপিএবি) মহাসচিব শওকত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, এ খাতে ছোট আকারের বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে বড় আকারের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল নিয়ে দেশী-বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠানই সেভাবে এগিয়ে আসছে না। এক্ষেত্রে আস্থার বিষয়টি যেমন রয়েছে, তেমনি আগ্রহেরও ঘাটতি আছে। বিনিয়োগ ছাড়াও আইন ও মেধাস্বত্বের মতো বেশকিছু বিষয় ডিজিটাল স্টার্টআপগুলোর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে ওঠেনি।
ডিজিটাল স্টার্টআপগুলোকে সহায়তা দিতে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি প্লাটফর্ম। এর মধ্যে রয়েছে স্টার্টআপ বাংলাদেশ, তরু, স্কেলআপ বাংলাদেশ, ওয়াইগ্যাপ অস্ট্রেলিয়া, ইএমকে, জিপি অ্যাকসেলারেটর, বাংলালিংক ইনকিউবেটর ও আর-ভেঞ্চার। স্টার্টআপের জন্য অফিস স্পেস, মেন্টরসহ অন্যান্য সহায়তা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান স্টার্টআপের জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগেরও জোগান দিচ্ছে। ইএমকে প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসেবে ৪-৫ লাখ ও ওয়াইগ্যাপ অস্ট্রেলিয়া ৪০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থায়ন করছে। আর এ খাতের নতুন উদ্যোক্তাদের স্টার্টআপ বাংলাদেশ ১০ লাখ ও তরু ১০ লাখ টাকা অনুদান দেয়।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এটি কার্নির তথ্যমতে, বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার খাত প্রতি বছর ৫০ শতাংশ হারে বাড়ছে। নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে ৭০ হাজারের বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশী-বিদেশী উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ পেয়েছে ডিজিটাল স্টার্টআপগুলো। এ বিনিয়োগের পরিমাণ ২৮ কোটি ডলারের বেশি। এর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিনিয়োগও রয়েছে।
ইউএসএআইডির পর্যবেক্ষণ বলছে, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি দেশের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখতে পারে। এটি একই সঙ্গে নতুন ধরনের বিনিয়োগকে যেমন আকৃষ্ট করতে পারে, তেমনি তরুণ প্রজন্মের মেধা কাজে লাগানোর ক্ষেত্র তৈরি করে। নতুন প্রযুক্তি ও ব্যবসার মধ্যে যোগসূত্র তৈরিতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ-সংক্রান্ত গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে এক্ষেত্রে।